ছোটবেলা থেকেই বিতর্কের প্রতি এক গভীর মুগ্ধতা ছিল তাঁর। টিভির পর্দায় যখন বিতার্কিকদের যুক্তি আর আত্মবিশ্বাসের ঝলক দেখতেন, তখন থেকেই মনে জন্ম নিত এক অব্যক্ত স্পৃহা—‘একদিন আমিও ওদের মতো কথা বলব।’ কিন্তু মফস্বল শহরের গণ্ডি এবং জিপিএ-৫-এর পিছনে ছোটার চিরাচরিত প্রতিযোগিতা সেই স্বপ্ন পূরণের পথে ছিল এক বড় বাধা। স্কুল-কলেজের সহশিক্ষা কার্যক্রমে বিতর্কের ‘স্বাদ’ তিনি পাননি।
এরপর শুরু হলো বিশ্ববিদ্যালয় জীবন। কিন্তু ভাগ্য তখনও পুরোপুরি সহায় হয়নি। পৃথিবীজুড়ে নেমে এলো করোনা মহামারী, স্থবির হয়ে গেল সব কার্যক্রম, যার মধ্যে ছিল ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ডিবেটিং সোসাইটির (ডিআইইউডিএস) কার্যক্রমও। তবে ভাগ্য যে তাঁর জন্য অন্য কিছু লিখে রেখেছিল!
করোনা-পরবর্তী সময়ে, অপ্রত্যাশিতভাবেই তাঁর বিতর্ক-যাত্রা শুরু হয়। প্রথমবার কোনো প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে তাঁর দল অর্জন করে রানার্সআপের সম্মান। বিতর্ক কী, কীভাবে করতে হয়, সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা না থাকলেও, শুধুমাত্র হৃদয়ের সেই পুরোনো ‘স্পৃহা’র জোরেই যেন তাঁরা ফাইনালে উঠেছিলেন। সেই অপ্রত্যাশিত সাফল্যই যেন মঞ্জুরুল ইসলামের ‘স্পৃহা নামক গাড়ির’ জ্বালানি হিসেবে কাজ করে।
এই যাত্রার পরবর্তী ধাপ আসে যখন তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় ডিবেটিং সোসাইটি আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় বিতর্ক প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। সেই প্রতিযোগিতা তাঁর ভেতরের ‘স্পৃহা’ গাড়ির ‘স্টার্ট বাটন’ হিসেবে কাজ করে। এরপরই তিনি ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ডিবেটিং সোসাইটি (ডিআইইউডিএস)-এর সক্রিয় সদস্য হিসেবে যুক্ত হন। কিন্তু পথ তো আর একা চেনা যায় না। এই ‘স্পৃহা’ নামক গাড়ির পথনির্দেশক হিসেবে তিনি পান তাঁর ডিপার্টমেন্টের বড় বোন ও ডিবেটিং সোসাইটির মেন্টর জান্নাতুল ফেরদৌস এবং মেন্টর কাওসার আলমকে।
আইনের ছাত্র হওয়ায় তিনি ‘মুট কোর্ট’ এর সঙ্গেও যুক্ত। মুট কোর্টকে অনেকে বিতর্কের সাথে তুলনা করলেও, মঞ্জুরুল ইসলাম সেই মতের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন। কারণ তাঁর মতে, মুট কোর্টের জন্য যে কঠোর প্রস্তুতি নিতে হয়, তা দিয়ে অনায়াসে ‘শ’ খানেক বিতর্ক করা সম্ভব। মুট কোর্টের অসংখ্য নিয়ম, ধাপ এবং শৃঙ্খলার কঠোর বেড়াজাল বিতর্কের মুক্ত আলোচনা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।
তবে বিতর্ক তাঁর জীবনে যে সবচেয়ে বড় পরিবর্তনটি এনেছে, তা হলো অদম্য আত্মবিশ্বাস। আগে যেখানে কথা বলতে সংকোচ কাজ করত, আজ সেখানে তিনি বিন্দুমাত্র দ্বিধা ছাড়াই মঞ্চে দাঁড়াতে পারেন। কণ্ঠস্বর কাঁপানো দুশ্চিন্তা আজ দূর হয়েছে। বিতর্ক তাঁকে শিখিয়েছে, কীভাবে সম্মান বজায় রেখেও দ্বিমত পোষণ করা যায়। যেকোনো সমস্যার দ্রুত সমাধান খুঁজে বের করা, দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা এবং পাঁচ মিনিটে বিতর্ক বা দশ মিনিটে ইংরেজিতে উপস্থিত বক্তৃতা দেওয়ার দক্ষতা তাঁর আয়ত্তে এসেছে এই বিতর্ক চর্চার মাধ্যমেই।
আজ তাঁর কাছে সবচেয়ে বড় অর্জন কোনো ট্রফি নয়, বরং আত্মবিশ্বাস। তিনি বিশ্বাস করেন, বিতর্ক কেবল একটি প্রতিযোগিতা নয়, এটি নিজেকে আবিষ্কারের একটি পথ। তাঁর সেই ‘স্পৃহা’ নামক গাড়ি এখন ধীরে ধীরে চলতে শুরু করেছে। অন্য বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের সঙ্গে বিতর্কের মাধ্যমে সেই গাড়ি এখন আত্মবিশ্বাসী হয়ে সুদীর্ঘ পথ চলতে প্রস্তুত।
পরিশেষে, মঞ্জুরুল ইসলাম গভীর কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন ডিআইইউডিএস-এর সম্মানিত মডারেটর মিলি রহমানকে, যিনি বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীদের বিতর্কের সেতুবন্ধনে যুক্ত রেখে মুক্ত চিন্তার এই ধারা অটুট রেখেছেন। তাঁর কাছে তিনি কেবল একজন মডারেটর নন, বরং সংকটে সমাধানের পথ দেখানো এক অকৃত্রিম অভিভাবক। একই সঙ্গে তিনি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন ডিআইইউডিএস এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের প্রতি।
মোঃ মঞ্জুরল ইসলাম
আইন বিভাগ, সক্রিয় সদস্য ডিআইইউডিএস
ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
মন্তব্য করুন